163 বার পঠিত
কেবল একটি ডিমের দাম ১৪-১৫ টাকাই বলে দেয় দেশের বাজার ও পোশাক শ্রমিকসহ শ্রমজীবী মানুষের বেহাল দশার কথা। শ্রমজীবীর স্বস্তা আমিষ ডিম ৪ সদস্যের একটি পরিবার যদি দিনে ১টি করেও খেতে চায় তাহলেই দরকার ১,৮০০ টাকা। অবশ্য বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষকেরা বলছেন , মৌলিক চাহিদা হিসাবে এই বাজারে বেঁচে থাকতে একটি পরিবারের ন্যূনতম ৪০ হাজার টাকার বেশি লাগে। তারপরও দেশ ও শিল্পের সামর্থ্য বিবেচনায় গত ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে পোশাক শ্রমিকেরা ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে রাজপথে আছে।
বাজারে দ্রব্যব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে ধার-কর্য, সঞ্চয়-ভাঙ্গা, কম-পুষ্টি, কম-খাবার, সন্তানদের শিক্ষা ও জরুরি মৌলিক চাহিদা কাটছাট করেও চলতে পারছে না শ্রমিক। অথচ এই বিপদকালে এখনো নতুন মজুরির ঘোষণা না-হওয়ায় পোশাক শ্রমিকেরা বিস্মিত। গত ৫ বছরে করোনাকাল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি, বন্যা, ডেঙ্গু ইত্যাদি সংকটে রপ্তানির অন্যান্য খাতের পতন হলেও পোশাকখাত তার অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। কেবল ২য় রপ্তানিকারক দেশই নয়-ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আমেরিকার বাজারে ভিয়েতনাম- চীনকে ছাপিয়ে বাংলাদেশ রপ্তানিতে শীর্ষে। কিন্তু তারপরও শ্রমিকেরা মজুরিতে পিছিয়ে।
৪০ লাখ শ্রমিকের এই শিল্প থেকে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪% ভাগ আসে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে এখাতে রপ্তানির হার ৪৬.৯৯ বিলিয়ন ডলারে (৪ হাজার ৬শ ৯৯ কোটি ডলার) পৌঁছেছে-যা গত বছরে ছিল ৪২.৬ বিলিয়ন ডলার (৪ হাজার ২শ ৬১ কোটি ডলার)। গত বছরের তুলনায় এখাতে রপ্তানির মোট ১০% বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। দুঃখজনক হলো বর্তমানে মালিকদের উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি। দুর্দশা বেড়েই চলেছে। দিনমান খেটেদেশের নাম বিশ্বের মানচিত্র তুললেও শ্রমিকের জীবন বদলায়নি।
এমনকি সরকারের চতুর্থশ্রেণির কর্মচারী, ব্যাংকের পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা নিম্নতম পদের কর্মী কিংবা স’মিল-জাহাজভাঙ্গা শ্রমিকের চেয়েও তারা পান কম মজুরি। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে রপ্তানিতে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশ ১৩৩ কোটি কেজি পোশাক রপ্তানি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও প্রবৃদ্ধিতে ৩৬.৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে যে শীর্ষ ১০ দেশ থেকে রপ্তানি হয়, বাংলাদেশ তার মধ্যে এগিয়ে । এমনকি ডেনিম রপ্তানিতে বাংলাদেশ সামনে। ইতোমধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের শিল্প করার সঙ্কল্প সার্বিক- ভাবে মালিকদের আয় বাড়ারই স্পষ্ট লক্ষণ।
এতকিছুর মাঝে শ্রমিকদের আয় ৫ বছর ধরে ৮০০০ টাকায় আটকে আছে। শ্রমিকরা হয়ে আছে দুনিয়ার সস্তা মজুর। চীনের পোশাক শ্রমিকের মজুরি ২৪,৮৯০ টাকা, ভিয়েতনামে ১৫,৬৬০ টাকা, তুরস্কে ২৯,১৬৫ টাকা, মালয়েশিয়ায় ২৫,৯৩৫ টাকা, ফিলিপাইনে ২৩,১৮০ টাকা, কম্বোডিয়ায় ১৮,৪৩০ টাকা অন্যদিকে বাংলাদেশে ৮,০০০ টাকা।
তাই এই সংকটকালে কোনোমতে বাঁচতে দ্রুত ২৫ হাজার টাকা মজুরি বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। একইসাথে পোশাক শ্রমিকেরা মনে করে, শ্রমিকের মজুরিতে বেসিকের পরিমাণ একটি জরুরি বিষয়, সেটি গত দশ বছরে কমে আসছে। যেখানে ১৯৯৪ সালে বেসিক ছিল ৬৫%, ২০০৬-এ ৬৮%, ২০১০-এ ৬৭%, ২০১৩-তে ৫৭% এবং ২০১৮-তে ৫১%-এ নেমে আসা শ্রমিকের প্রাপ্যতে এক বিরাট ধাক্কা। শ্রমিকের মূল মজুরির উপর অন্যান্য পাওনা যেমন ওভারটাইম, গ্রাচুইটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, বাৎসরিক ছুটির টাকা, ইনক্রিমেন্টসহ নানাকিছু নির্ভর করে সেইক্ষেত্রে এবার মজুরি কাঠামোতে পরিবর্তন এনে বেসিক মোট মজুরির অন্তত ৬৫% করার প্রস্তাব করেছে তারা।
সামনে জাতীয় নির্বাচন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি অনিশ্চয়তার দিকে এগোচ্ছে। শ্রমিকের দুর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের ‘লাম-সাম মজুরি’ ধরিয়ে দেবার চেষ্টা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয় ।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পোশাক শ্রমিকদের ৮দফা দাবি বাস্তবায়নে সরকারকে জোর দাবি জানায়, তাদের দাবিগুলো হলোঃ দ্রুত মজুরি ২৫ হাজার টাকা ঘোষণা করতে হবে ও মজুরি বোর্ডকে জবাবদিহি করতে হবে। অন্তত ৬৫% বেসিক ও নতুন মজুরি ঘোষণার আগ পর্যন্ত ৬০% মহার্ঘ্যভাতা দিতে হবে।বৈষম্য নয়, ইপিজেড এবং ইপিজেডের বাইরে সমান হারে মূল মজুরির ১০% ইনক্রিমেন্ট দিতে হবে। বাধ্যতামূলক প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করতে হবে। পোশাক শ্রমিকদের মজুরি কাঠামোতে ৭ গ্রেড কমিয়ে ৫ গ্রেড করতে হবে। দ্রব্যমূল্য কমাতে অবিলম্বে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। শ্রমিক ও শিল্পস্বার্থে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমিয়ে সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার ও মালিককে উদ্যোগ নিতে হবে।সোয়েটার ও পিসরেট-এ কর্মরত শ্রমিকের কাজের আগে মজুরি নির্ধারণ ও ডাল সিজেনে পূর্ণ বেসিক দিতে হবে। সোয়েটারে ৩ শিফট এবং ওভারটাইম নিশ্চিত করতে হবে।নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য রেশন কার্ডের মাধ্যমে বিতরণে স্থায়ীভাবে রেশনিং চালু করতে হবে। শ্রমিকদের জন্য জীবন বিমা, চিকিৎসা, মাতৃত্বকালীন যথাযথ সুবিধা, শিক্ষা এবং জরুরি তহবিল নিশ্চিতে সরকার, মালিক ও বায়ারকে উদ্যোগ নিতে হবে।শ্রমিক ছাঁটাই, মিথ্যা মামলা-হামলা ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মালিক, সরকার এবং বায়ার এই তিন পক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আক্তারের সাথে মুঠোফোন যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে চাল, ডাল, তেলসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। পোশাক শ্রমিকেরা ৮ হাজার টাকায় সংসার কীভাবে চালায়? তার খোঁজ রাখে কেউ। আমাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া না হলে ‘দুনিয়ার মজুরি এক হও’ শির্ষক গন আন্দোলন হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন ।
শিক্ষার্থীঃ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ