17 বার পঠিত
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সাত মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও সকল জড়িতদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিগত বছরের ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৮তম সিন্ডিকেট সভায় দুই শিক্ষক এবং সাত জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অন্যদিকে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৯তম সিন্ডিকেট সভায় আবু সাঈদ হত্যা মামলায় জড়িত ৭১ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বোর্ড ৩৩ জনকে দুই সেমিস্টার, ২৩ জনকে এক সেমিস্টার এবং ১৫ জন সাবেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৫ জনের তালিকায় রয়েছেন পোমেল বড়ুয়া, শামীম মাহফুজ, ধনঞ্জয় কুমার টগর, বাবুল হোসেন, বিধান, তানভীর, গ্লোরিয়াস (ফজলে রাব্বি), আদুল্লাহ আল নোমান খান, আরিফুজ্জামান ইমন, গাজীউর, শাহিদ হাসান ও মামুন, রিফাত, ফারহাদ হোসেন এলিট ও মোমিনুল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি, হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া অনার্স-মাস্টার্স শেষ করা সম্মুখসারির ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন মামলা দায়ের করে সার্টিফিকেট বাতিল করা হয় তাদের। হামলায় জড়িত এক-দুই সেমিস্টারের জন্য বহিষ্কৃত হওয়া শিক্ষার্থীদের বিষয়টিও পুনর্বিবেচনার দাবি জানান তারা।
পাশাপাশি, হামলার সময়ে ইট-পাটকেল ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে আক্রমণাত্মক আচরণ করছিলেন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাদের নামও শাস্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা আরও জানান, আবু সাঈদের হত্যা মামলায় এজহারভুক্ত আসামি মাত্র ২৪ জন কিন্তু ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল শতশত মানুষ কিন্তু মামলার বাদীপক্ষ চেষ্টা করেছে যারাই প্রকৃত অপরাধী তারাই যেন এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত হন। ফলে শুধু যারা প্রকৃত পক্ষে এই হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তারাই অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এখানে। তেমনি হামলার মামলার ক্ষেত্রেও যারা প্রকৃত পক্ষে শিক্ষার্থীদের উপর সহিংসতায় জড়িয়েছিল তারাই যেন এই মামলায় অভিযুক্ত হয়।
অপর দিকে, ১৬ জুলাইয়ে অফিস খোলা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষক নিরস্ত্রভাবে পেশাগত কারণে নিজেদের প্রয়োজনে কিংবা কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন, কিন্তু হামলার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল না— এমন ব্যক্তিদের নাম বাদ দেওয়ার পক্ষে কথা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দপ্তর রাজনীতির কারণে ও ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে বেশকিছু কুচক্রী মহল নিরপরাধ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম শাস্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।
এ ছাড়া, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিতের কথাও বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ প্রসঙ্গে আবু সাঈদের বাল্যবন্ধু ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ হাসান শাকিল বলেন, ১৬ জুলাইয়ে অফিস খোলা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষক নিরস্ত্রভাবে পেশাগত কারণে বা নিজেদের প্রয়োজনে কিংবা কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন এটি আমরা লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু হামলার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল না, বাট আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ করেছি বা এখনো লক্ষ করেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু কুচক্রী মহল তারা নিজেদের নাম প্রকাশ না করে তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব বা রাজনীতির কারণে অনেক নিরপরাধ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমনকি শিক্ষকদেরও নাম শাস্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা এটি স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী বা কোনো শিক্ষক যদি অস্ত্র, লাঠি, বা ইট পাটকেল সহকারে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকেন বা তাদের মুভমেন্ট যদি এমন থাকে যেটি দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করবে শুধু তাদেরকেই এই সহিংসতা মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এর বাইরে যদি আমরা লক্ষ করি যে, কোনো ব্যাক্তির হাতে অস্ত্র, লাঠি বা ইটপাটকেল কিছুই নেই বা তার মুভমেন্ট ও হামলা করার মতো না এমন কোনো ব্যাক্তির নাম যদি এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেটি কখনোই মেনে নিব না। আমরা চাই যারা সত্যিকারের অপরাধী, যারা সত্যিকার অর্থেই শিক্ষার্থীদের উপর সহিংসতায় জড়িত ছিল এই মামলায় যেন তাদের নামগুলোই আসে। কিন্তু কেউ যদি ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কারো নাম এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার অপচেষ্টা করে আর সেটি যদি আমাদের কানে আসে তাহলে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেটি কখনোই মেনে নিব না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি আরমান হোসেন বলেন, সহিংসতার মামলায় ওই সকল ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত হবে যারা জুলাই বিপ্লবে প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সাথে জড়িত ছিলো। যাদের হাতে মারণাস্ত্র ছিল, লাঠি-সোঁটা ইত্যাদি ছিলো। উল্লেখ্য যে, এখানে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি ঘটনাস্থলে শুধুমাত্র উপস্থিত থাকার কারণে অন্তর্ভুক্ত হবে না। সুষ্ঠু প্রমাণসাপেক্ষে যারা চিহ্নিত হবে, তারাই কেবল অভিযুক্ত হবে।উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন শাস্তির আওতায় না আসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ডরমিটরির(আবাসিক) কয়েকজন শিক্ষক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১নম্বর গেট ব্যতিত অন্য গেটগুলো কোনো নোটিশ ছাড়াই বন্ধ থাকায়, অনেকেই ১নম্বর গেট (ঘটনাস্থলে) দিয়ে প্রয়োজনের তাগিদে যেতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে অনেকেরই বিভিন্ন রকম ফুটেজ আসাই স্বাভাবিক, কিন্তু তা বিকৃতভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সেক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধিদের আরাল করার অপপ্রোয়াস চালানো হচ্ছে।
তারা আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যান্তরীন কিছু কুচক্রী মহল ব্যক্তিগত আক্ষেপ থেকেও অনেকের নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য বিভিন্ন প্রকার দুরভিসন্ধি করছেন।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. ফেরদৌস রহমান বলেন, হামলায় জড়িত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পুঙ্খানুপুঙ্খ তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। হামলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি গেটের মধ্যে একটিই খোলা থাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালনে এবং লাঞ্চের সময় হওয়ায় অনেকেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তবে উপস্থিত থাকা মানেই হামলাকারী নয়। তাই কোনো মহল যদি নিজেদের ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কাউকে অপরাধী বানাতে চায়, তারা সে ক্ষেত্রে সফল হবে না। আমরা যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত করব যেন কোনো অপরাধী নিরপরাধ এবং কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন অপরাধী হিসেবে পরিগণিত না হয়।