121 বার পঠিত
কিশোরগঞ্জ(নীলফামারী)প্রতিনিধি>আবহমান গ্রামবাংলার চাকাবিহীন ঐতিহ্যবাহী বাহনের নাম পালকি।যা ছিল যান্ত্রিক বিহীন যুগে রাজা-বাদশাসহ অভিজাত পরিবারের লোকজনের যাতায়াত ও নববধূ-বরকে পরিবহনের একমাত্র বাহন।এ বাহনের সহজ নির্মানশৈলী,আয়েশি চলাফেরা,রাজকীয় মর্যাদা,বর-কনের নান্দনিক বহন,বহনকারি বেহারাদের নানা ছন্দ তোলা হৃদয় দোলানো গানের সুর সব মিলে পালকি বাঙালির মানষপটসহ শিল্প-সাহিত্যে বিশেষ অবস্থান করে নেয়।
পালকি চলে,পালকি চলে/গগনতলে আগুন জ্বলে..ছন্দের যাদুকরের কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পালকির গান কবিতায়।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বীরপুরুষ কবিতায় লিখেছেন মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দুরে/তুমি যাচ্ছ মা পালকিতে চড়ে,শিশুতোষ এমন নানা ছড়া,কবিতায় নানান উপমায় কবি-সাহিত্যিকদের লিখনিসহ নাটক-সিনেমায় বার বার উঠে এসেছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন পালকির কথা।কিন্তু কালের বির্বতনে ও যান্ত্রিক সভ্যতার ভিড়ে গ্রাম-বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি থেকে এ ঐতিহ্যবাহী বাহন হারিয়ে গেছে।
ঐতিহ্যের স্মৃতিকে লালন করে পালকি সংরক্ষণ করা হয়েছে যাদু ঘরে,লোককারু শিল্পে ও বইয়ের গল্প-কবিতায়।তবে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে বই কিংবা ওইসব স্থানে গিয়ে নয়,বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের মাঝে পালকির ঐতিহ্য তুলে ধরতে মাসব্যাপি চলছে পালকি উৎসব।এর আয়োজন করেন,রুহুল আমিন নামে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক।তিনি নিজস্ব অর্থায়নে পালকি তৈরি করে তা সম্প্রতি সময়ে পহেলা বৈশাখে উপজেলার শহর-গ্রাম,পাড়া-মহল্লায় ঢাক-ডোল পিটিয়ে বর্তমান প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরার পাশাপাশি উত্তর দুরাকুটি গ্রামে অবস্থিত সৃষ্টি বৈকালিন শিক্ষাকেন্দ্র সংলগ্ন এক সংগ্রহ শালায় মাসব্যাপি চলছে পালকি উৎসব।যা দেখার জন্য নানা প্রান্তের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ভিড় করছেন প্রতিনিয়ত।ওই শিক্ষক জানান,পালকির ঐতিহ্য বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরার পাশাপাশি এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের পালকিতে চড়ে বিয়ের আবদার মেটাতে তার এমন প্রয়াস।
প্রবীণরা জানান,এক সময় বর-কনে বাহনের অন্যতম মাধ্যম ছিল পালকি।যারা পালকি বহন করতো তাদেরকে বেহারা বলা হত।তারা যখন রঙিন ঝালর দেওয়া আর নানা রঙের ফুল কাগজে সাজানো পালকিতে নতুন বউকে নিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে হেঁটে যেতেন তখন তাদের ছন্দবদ্ধ গানের কন্ঠে ভেসে উঠত হুন হুনা হুনরে চার বেহারার পালকিতে চড়ে যায়রে কন্যা পরের ঘরে..।কর্তাবাবুর রঙটি কালো,গিন্নি মায়ের মনটি ভাল,সামলে চলো হেঁইও হেঁইও জোয়ান সরু আল চলো ধীরে,কর্তাবাবুর দরাজ দিল দেবে ছিড়ে..এমন ছন্দতোলা হৃদয় দোলানো সুর শুনে উৎসুক পরশিরা রাস্তার পাশে দাঁড়াত লাল শাড়ি পড়া ঘোমটা দেওয়া নববধূর মুখখানি দেখার জন্য।এছাড়াও মেহেদি তোলার প্রতিটি দৃশ্যের বর্ণনায় উঠে আসত বেহারাদের সুরে-ছিল মেন্দি হিন্দুস্তানে,আইলো মোন্দি পাকিস্তানে,এই মোন্দি তুলিবে কে?দুলাইনের বড় ভাবিরে…।
ছেলের মাকে খুশি করার জন্য বরের বাড়ির নিকটবর্তী হলে বেহারা ধরতেন নতুন গান-আল্লাবোল,ওরে বোল,মাইয়ার মারে দিস গোল,পোলার মারে স্বর্গে তোল সেই কোদালে ছাঁচে হিসে দুলার বাপের বাড়ি রে,সেই কোদালে ছাঁচে দুলহানের বাপের দাড়ি রে..।শুধু পালকি নয়,পালকি বেহারাদের এমন সুনিপূণ নানা ছন্দমালা হৃদয় দোলানো গানের সুর মুগ্ধ করেছিল সবাইকে।কিন্তু আধুনিক যুগের জাঁকজমকপূর্ণ,কার,বাস,মাইক্রোবাস যানে পিষ্ট হয়ে বেহারা ও তাদের কন্ঠের ছন্দমাখা সুর আর পালকি কালের অতলগহবরে হারিয়ে গেছে।কিশোরীগঞ্জ মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শাহিন ইসলাম বলেন,পালকি শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ পালঙ্ক থেকে,যার অর্থ শয্যা বা বিছানা।আর উপমহাদেশে পালকির প্রচলন কখন হয়েছিল,তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।তবে পালকির উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও বাল্মিকীর রামায়ণে পালকির কথা উল্লেখ রয়েছে।তাই ধারণা করা হয় আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে পালকির প্রচলন শুরু হয়ে ছিল।
শুধু ওই উপমহাদেশে নয়,এর বাইরে বিভিন্ন দেশে পালকির প্রচলন ছিল।পালকি কাঠের তৈরি একটি চৌকানো আয়তাকার বাক্স বিশেষ।এর দু পাশে দুটি দরজা থাকে এবং দুই মাথায় দুটি লম্বা মোটা কাঠের হাতল থাকে।যা কাঁধে নিয়ে বেহারারা পালকি বহন করত।পালকি সাজানো হত দামি কাপড় দিয়ে।একসময় সব শ্রেণিপেশার সৌখিনপ্রিয় বাঙালির বিলাসবহুল বাহন ছিল পালকি।কালেরবির্বতনের পালকির প্রচলন হারিয়ে গেছে।শিক্ষক রুহুল আমিনের মত সেই সময়ের স্মৃতি সংরক্ষণপূর্বক নতুন প্রজন্মের মাঝে বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।তাতে করে নতুন প্রজন্ম আমাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারনা লাভ করতে পারবে।
,