277 বার পঠিত
ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকুট গ্রামে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যন্য ঐতিহাসিক নির্দশন হিসেবে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি সতীদাহ মন্দির। যা ভারতীয় উপমহাদেশে আরেকটি অক্ষত আছে কিনা জানা নেই। এখনো সন্ধ্যা নেমে এলে এই পথে ভয়ে ভয়ে হেঁটে যায় সাধারণ মানুষ! বিদ্যাকুট ও মেরকুটা গ্রামের মাঝামাঝি রাস্তার মোড়ে খালের ধারে বিদ্যাকুট গ্রামের দেওয়ান রাম মানিক সতীদাহ মন্দিরটি পাকাকরণ করেন। জনশ্রুতি আছে, সর্বশেষ রাম মানিকের মাতা তার প্রয়াত স্বামীর সাথে সহমরণে যাওয়ার পর একটি নামফলক লাগানো হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নামফলকটি ধ্বংস প্রাপ্ত হয় বলে জানা যায়।
সতীদাহপ্রথা নিয়ে ঐতিহাসিক নানা মতবাদ রয়েছে। সনাতন ( হিন্দু) ধর্মালম্বীদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ বেদে সতীদাহপ্রথা নিয়ে উল্লেখ না থাকলেও মহাদেব শিবের সহধর্মিণী সতীর নামে ” সতীদাহ” নামকরণ করা হতে পারে বলে ধারনা করা হয়।
সতী ভবঘুরে শ্মশানবাসী শিবকে বিয়ে করায় সতীর পিতা রাজা দক্ষ শিবকে কটাক্ষ করে অপমানিত করে। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে সতী আত্মহত্যা করে।
অন্য আরেকটি ঐতিহাসিক বর্ণনা পাওয়া যায় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজীর শাসন আমলের।
সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজী ছিলেন সম্রাট জালাল উদ্দীন খিলজীর চাচাতো ভাই। তিনি সুদূর আরব থেকে আইন প্রনেতা এনে ভারতীয় মহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে শাসন করার জন্য নজরে – এ – মরেক ও নজরে – এ – বেওয়া নামে দুটি আইন প্রয়োগ করেন।
নজরে – এ – মরেক ছিল হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিয়ের উপর ধার্য করা কর ও নজরে – এ – বেওয়া ছিল বিধবা ও নিঃসন্তান নারীদের উপর ধার্য করা সম্রাটের কর।
এও জনশ্রুতি আছে, ময়মনসিংহে নবাবের নিযুক্ত সিন্ধুকী নামে একদল লোক ছিল। যাদের কাজ ছিল ঘুরে ঘুরে দেখা কার বাড়িতে সুন্দরী নারী ও বিধবা রয়েছে।
উপরোক্ত দুটি কর ছিল আইন প্রনেতাদের ইচ্ছামাফিক। তারা যা ধার্য করতো সেই ধার্য করা কর কেউ দিতে না পারলে বিধবা, নিঃসন্তান ও সদ্য বিবাহিত নারীকে তারা দাস হিসেবে বাজেয়াপ্ত করে সম্রাটের হাবেলিতে নিয়ে রাখতো।
এই আইন থেকে বাঁচতে উচ্চ বর্নের হিন্দুরা তৎকালীন প্রচলিত “স্বয়ংবরা প্রথা” বন্ধ করে “গৌরি দান ” ও সতীদাহ নামে দুটি প্রথা প্রচলিত করে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায় ।
সতীদাহপ্রথা তখন অনেকটা অনার কিলিং এর মতো নিজের ইজ্জত ও মান রাখতে প্রথম দিকে বিধবারা স্বেচ্ছায় সহমরনে গেলেও ধীরে ধীরে এটি প্রথায় রুপ লাভ করে এবং এর নির্মম বলি হতে থাকে একের পর এক নারী।
তাছাড়া কোন কোন তথ্য মতে ব্রাহ্মনদের আধিপত্য ও গোঁড়ামীকেও এর জন্য দায়ী করা হয়।
যা ১৮২৯ সালে ব্যাপ্টিক যাজক উইলিয়াম কেরি ও রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করে আইন প্রনয়ন করেন।
৫০০ বছর ধরে চলা সতীদাহপ্রথাকে নিষিদ্ধ করায় হিন্দু ধর্মে হস্তক্ষেপ ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অযুহাতে বাংলা, উড়িষ্যা সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের গোঁড়া হিন্দু ধর্মালম্বীরা আইনটির বিরুদ্ধে পিটিশন জারী করেন।
পিটিনের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ হয়ে লড়েন রাজা রামমোহন রায় এবং আইনটি কার্যকর হয়। ১৮২৯ সালে আইনটি পাস হলেও ভারতের সর্বত্র বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইনটি কার্যকার হয় ১৮৩৫ সালের অনেক পরে।
কথিত আছে রাজা স্বরুপ সিং মৃত্যুবরন করলে তার কোন স্ত্রীই সহমরনে যেতে রাজি হয়নি। যার খবর সারা ভারত বর্ষে ছড়িয়ে পড়লে অন্যদের সহমরনে না যেতে উৎসাহিত করে।
সতীদাহ কথাটি সহমরণ, সহগমন হিসেবেও প্রচলিত।
নবীনগরস্থ বিদ্যাকুটের সতীদাহ মন্দিরটি গোলাকার মঠ আকৃতির উপরের দিকে খোলা আনুমানিক ২০ ফুট উচু ইটের দালান। মন্দিরটির এক পাশে একটি দরজা ( প্রবেশ পথ) ও চারদিকে চারটি ভেন্টিলেটারের মতন ইষৎ গোলাকার খুপরি রয়েছে। যে খুপরি গুলো দিয়ে আগুন উসকে দেয়া ও জ্বালানি সরবরাহ করা হতো বলে ধারণা করা হয়।
বর্তমানে সংস্কারের কারনে এর খুপরি গুলো বন্ধ করে দিয়ে উপরে গম্বুজ আকৃতির ছাদ দেয়া হয়েছে।
সহমরন, সহগমন করার আগে সদ্য বিধবা হওয়া নারীকে প্রচুর পরিমাণে বাং বা মদ খাওয়ানো হতো। কোন কোন ক্ষেত্রে সদ্য বিধবা হওয়া নারী সহমরনে যেতে না চাইলে তাকে জোর করে বাং খাওয়ানোর পর মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করা হতো। নির্মম ও পৈশাচিক এই প্রথাটি আজ না থাকলেও রয়ে গেছে এর স্মৃতি চিহ্ন!
সতীদাহ নিয়ে লেখা হয়েছে গল্প, উপন্যাস, গান, কবিতা ও নির্মিত হয়েছে অনেক নাটক, সিনেমা ও ডকুমেন্টারি।
বিশেষ করে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানা লেখায় উঠে এসেছে সতীদাহপ্রথার নানা নির্মম কাহিনী।
কিভাবে যাবেন : ব্রাহ্মনবাড়িয়া, নবীনগর, কৃষ্ণনগর, গোসাইপুর থেকে লঞ্চ কিংবা নৌকা যোগে মোহল্লা অথবা মেরকুটা নেমে ২০/৩০ টাকা রিক্সা ভাড়ায় বিদ্যাকুট সতীদাহ মন্দিরে চলে যেতে পারবেন। অনুভব করতে পারবেন সেই সব নারীর আর্ত চিৎকার, বাঁচার আকুতি, নির্মম ও জগন্য হত্যাকান্ডের স্মৃতি। আপনার ভ্রমন শুভ ও সুন্দর হউক এই প্রত্যাশা।