252 বার পঠিত
বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে রচিত হয় জাতির এক গৌরহবময় অধ্যায়। যেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানাধীন তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তেলিয়াপাড়া চা বাগানে এসে তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করেন। সীমান্তবর্তী ও নির্জন স্থানে হওয়ায় এই স্থানটিকে অধিক নিরাপদ মনে করেছিলেন স্বাধীনতাকামী সেনা সদস্যরা।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালির ওপর নির্বিচারে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার পরপরই শুরু হয় বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু তখনো যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক কোন ছক বা রণকৌশল গ্রহণ করা হয়নি।
মার্চ মাসের শেষে মাধবপুর ডাকবাংলোতে অবস্থান নেন মেজর খালেদ মোশাররফ। তেলিয়াপাড়া বাসিন্দা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ আলীকে তিনি চা বাগান থেকে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা তৈরির নির্দেশ দেন। চা শ্রমিকেরা জঙ্গল কেটে রাস্তা গড়লে তেলিয়াপাড়া বিওপির কাছে ভারতীয় বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মেজর খালেদ মোশাররফ। এ সময় খালেদ মোশাররফ ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের কাছে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা বাঙালি সেনা অফিসার ও ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার জন্য সহযোগিতা চান। সহযোগিতার আশ্বাস পেলে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর কাজী মোহাম্মদ শফিউল্লাহ ১ এপ্রিল চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের মেজর খালেদ মোশারফের সঙ্গে যৌথভাবে সদর দপ্তর স্থাপন করেন। ৪ এপ্রিল সকাল দশটায় তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের রণকৌশল নির্ধারণের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসেন তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২৭ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সেই বৈঠকে অংশ নেন কর্নেল (অবঃ) মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী, কর্নেল (অবঃ) মোহাম্মদ আব্দুর রব, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দিন মোহাম্মদ রাজা, মেজর এ এন এম নুরুজ্জামান, মেজর কাজী মোহাম্মদ শফিউল্লাহ, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শাফায়েত জামিল, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর মঈনুল হোসেন, ক্যাপ্টেন আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিন, লেফটেন্যান্ট সৈয়দ ইব্রাহিম, লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ খান, লেফটেন্যান্ট সেলিম, লেফটেন্যান্ট মাহবুবুর রহমান সহ মোট ২৭ জন বাঙালি অফিসার।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য মাওলানা আসাদ আলী, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, মোস্তফা আলী ও এনামুল হক মোস্তফা শহীদ।
ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে তারা মুক্তিযুদ্ধের মূল রণকৌশল নির্ধারণ করেন। জ্যেষ্ঠতম বাঙালি অফিসার হিসেবে কর্নেল (অবঃ) আতাউল গণি ওসমানীকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বা মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।
সভায় বাংলাদেশকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে সেক্টর গঠনের ব্যাপারে প্রস্তাব তুলে মুক্তিপাগল সেনাসদস্যরা। মেজর কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহকে দেয়া হয় বৃহত্তম সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে সমগ্র কুষ্টিয়া, যশোর, দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তরাংশের যুদ্ধ পরিচালনার ভার। বৃহত্তর কুমিল্লা, ঢাকা, নোয়াখালী অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর খালেদ মোশাররফকে। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে।
তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক এই বাংলোটি তিন নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে সদ্য নিযুক্ত মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী পিস্তল উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন।