9 বার পঠিত
Karl Marx ছিলেন একজন দ্বান্দ্বিক সমাজবিজ্ঞানী। তিনি প্রতিনিয়ত সমাজের মাঝে দ্বন্দ্ব খুঁজে পান। এছাড়া তিনি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক। তিনি শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্ব (Class Struggle Theory) উপস্থাপন করেন। এটি হলো সমাজতান্ত্রিক এবং মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজের শ্রেণিসমূহের মধ্যে সংঘাত এবং তাদের ক্ষমতা ও সম্পদ নিয়ে দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ। এই তত্ত্ব মূলত কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাদের বিখ্যাত গ্রন্থ “The Communist Manifesto” এবং “Das Kapital” গ্রন্থে উপস্থাপনা করেন। Karl Marx মনে করেন সমাজে নানা কারণে বিভাজন হয়ে থাকে। তবে শ্রেণি বিভাজন মূলত দুই প্রধান শ্রেণির মাঝে হয়। তিনি বুর্জোয়া (Bourgeoisie) ও প্রলেতারিয়াত (Proletariat) হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি বুর্জোয়া বলতে বুঝিয়েছেন যারা উৎপাদনের উপকরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আর প্রলেতারিয়াত (Proletariat) যারা তাদের শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং তাদের নিজস্ব জমি নেই। ফলে তারা সমাজে সর্বহারা হয়ে বুর্জোয়াদের শোষণের শিকার হয়। বুর্জোয়ারা প্রলেতারিয়াতের শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য (surplus value) দখল করে, যা তাদের মুনাফার উৎস। Karl Marx এর তত্ত্ব বর্তমান সমাজে বিরাজমান। এমন বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় চা শ্রমিক আর চা কোম্পানির মধ্যে। মার্ক্সের মতে, শ্রমিক শ্রেণির উৎপাদনের উপকরণের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চা শ্রমিকরাও একই পরিস্থিতির শিকার। চা বাগানের মালিক বা কোম্পানি (বুর্জোয়া শ্রেণি) চা উৎপাদনের সকল উপকরণ নিয়ন্ত্রণ করে। চা শ্রমিকরা শুধু তাদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং এর বিনিময়ে সামান্য মজুরি পায়।
আমরা জানি চা একটি অর্থকরী ফসল। প্রতি চা রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা হয়। চায়ের দাম বৃদ্ধি পেলেও শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পায় নি। আর সেখানে অন্য ফসল তেমন হয় না। সুতরাং চা শ্রমিক অন্য কাজ করতে পারে না। তারা বাধ্য হয়ে শোষিত হয়ে শ্রম দেয়। কিন্তু সারাদিন এত খাটুনি করে ১৭০ টাকা মজুরি পায় এবং তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা দুর্বিষহ অবস্থা। অন্যদিকে উৎপাদন শক্তি বিকাশের ফলে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সূত্রপাত এবং বিকাশ ঘটতে লাগলো। ফল স্বরূপ সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা একসময় ধ্বংসের মুখে উপনীত হয়।
সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে জন্ম নিয়েছে আধুনিক পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজ। এই সমাজ যেহেতু শ্রেণীবিভক্ত তাই সমাজের মধ্যে শ্রেণী সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি, বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। নতুন নতুন শ্রেণী এবং অত্যাচারের নতুন ব্যবস্থা এবং অবশ্যই সংগ্রামের নতুন ধরন। বুর্জোয়া সমাজের শ্রমিক শ্রেণী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মজুরি বৃদ্ধি এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আদায় করার জন্য বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই শ্রেণী সংগ্রামটির রূপ হল বুর্জোয়া চিন্তা এবং ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা এবং সাম্যবাদের পক্ষে সংগ্রাম। এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায় চা শ্রমিকদের মাঝে। এক সময় তারা আন্দোলন করে তাদের মজুরি যেন বৃদ্ধি করা হয়। কারণ একটি দেশে সব অঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ না। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতি একই। ফলে একজন চাকরিজীবী এক কেজি চাল কিনতে পারলেও চা শ্রমিক কিনতে পারে না, চালের দাম একই হওয়া স্বত্তেও। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে চা শ্রমিকদের মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা করা হয়। এই মজুরি চা মূল্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এই শোষণ ও বৈষম্যের কারণে শ্রেণিসমূহের মধ্যে একটি সংঘাত তৈরি হয়। মার্কসের মতে, প্রলেতারিয়াত শ্রেণি সচেতন হয়ে বিপ্লব ঘটাবে এবং একটি শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে। এমন সচেতন হয়ে আন্দোলন করলেও চা শ্রমিক দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে নি আন্দোলন। কারণ তারা এত সর্বহারা যে দিনে উপার্জন করে দিনে খায়। প্রতিটি যুগে একটি শাসক শ্রেণি এবং শোষিত শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকে। Karl Marx চেয়েছিলেন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে কোনও শ্রেণি থাকবে না এবং সবাই সমানভাবে সম্পদের ভাগীদার হবে। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজে তা সম্ভব নয়। কারণ সমাজে কেউ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সমাজে বাস করতে শ্রেণি বিভাজন দরকার। সকলে একই শ্রেণির হলে সমাজ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। উদাহরণস্বরুপ মানুষের কাছে অর্থ সম্পদ আছে, কিন্তু বাজার নাই।
মার্কস এবং এঙ্গেলসের মতে, শ্রমিক শ্রেণীর বুর্জোয়া বিরোধী আন্দোলনের সর্বোচ্চ পর্যায় হল এই রাজনৈতিক সংগ্রাম। এই সংগ্রামের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণীর হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। এই জন্যই মার্কস মন্তব্য করেছেন শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তিত হয়ে চলবে এবং এই শ্রেণী সংগ্রামের ফলেই শ্রমিক শ্রেণী বুর্জোয়াদের হাত থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার অধিকার দখল করে নিতে সক্ষম হবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র। কিন্তু তাদের মন্তব্য বর্তমান সমাজে গ্রহনযোগ্য বিবেচিত হয় না। কারণ সর্বহারা শ্রেণি সংগ্রাম করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলে ক্ষমতার রদবদল হবে মাত্র। তারা হয়ে যাবে বুর্জোয়া। তেমনি অতীতের বুর্জোয়াদের মত শাসন করবে।
চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রা এবং শ্রমের অবস্থার বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে তারা মার্ক্সের “শ্রমিক শ্রেণি” তত্ত্বের একটি বাস্তব উদাহরণ। তাদের শোষণ এবং বৈষম্য দূর করতে হলে শ্রেণি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকৃত পরিবর্তনের পথে এগোতে হবে।