স্থানীয় সরকারের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদসহ সব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকাকে হারানো এমপি-মন্ত্রীদের ওপর নাখোশ দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। বেশ কয়েকজন এমপি-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ইউপি নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে অংশ নেয়া প্রার্থীদের মদদ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
দলের কার্যনির্বাহী বৈঠকে সাংগঠনিক সম্পাদকদের দেয়া তৃণমূলের আমলনামা দেখার পর থেকেই নাখোশ দলের হাইকমান্ড। অভিযুক্ত এসব এমপি-মন্ত্রীর সঙ্গে দলীয় সভাপতি দেখাই দিচ্ছেন না। কোনোভাবে দেখা হলেই অভিযুক্তদের আমলনামা স্মরণ করে দিয়ে ‘কী কারণে এসেছো?’ এমন প্রশ্নও ছুড়ে দেয়া হচ্ছে।গত ১০ ফেব্রুয়ারি ৮ম ধাপের মাধ্যমে শেষ হয় এবারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনের প্রতিটি ধাপে ছিলো নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী। সংখ্যাও কম নয়, প্রায় দেড় হাজারের অধিক।
তারা আবার দলেরই নেতা। সেই বিদ্রোহীদের মদদদাতা হিসেবে আড়ালে ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। তৃণমূলের বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক নেতারা বোঝানোর পরও আমলে নেননি এমপিরা।
প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করলেও গোপনে অনেকের বিরোধিতার প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। প্রতি ধাপের প্রতিটি জেলার কোনো না কোনো সংসদ সদস্য নৌকার বিরোধিতা করেছেন। তার জের হিসেবে নৌকার ভরাডুবি দেখতে হয়েছে কেন্দ্রকে।
সপ্তম ধাপের নৌকার ভরাডুবি ছিলো নজর দেয়ার মতো। সেই নির্বাচনে নৌকাকে পেছনে ফেলে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশিসংখ্যক ইউপিতে জয় পেয়েছেন। ১৩৮টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪২টি, স্বতন্ত্র প্রার্থী ৮৬টি, জাতীয় পার্টি ৩টি (জাপা) ও জাতীয় পার্টি (জেপি) ১টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছে। নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে ৪টি ইউপিতে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যারা নৌকা প্রতীকের বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং তাদের যারা মদদ দিয়েছেন তারা যেন দলীয় পদে আসতে না পারে- সেদিকে নজর দেয়ার তাগিদ দেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।
জানা গেছে, গত বছরের ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক। সেই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। বৈঠকে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে অংশ নেয়া বিদ্রোহী প্রার্থীদের শাস্তির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়। সেই বৈঠকে তৃণমূলের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদকরা। সেদিন বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা লিখিত রিপোর্টও জমা দেন। বৈঠকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের তৃণমূল পর্যায়ের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা সম্প্রতি আলাপকালে বলেন, আওয়ামী লীগের যেসব সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী বিভিন্ন নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সহযোগিতা করেছেন, মদদ দিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে দলের হাইকমান্ড খোঁজখবর নিচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকশ অভিযোগও দলীয় কার্যালয়ে পড়েছে।
সেই অভিযোগের সত্যতাও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যারা বিভিন্ন নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, যারা বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করেছেন বা মদদ দিয়েছেন, তাদের কেউই ভবিষ্যতে দলে কোনো পদ পাবেন না। এমনকি ভবিষ্যতে যেকোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও পাবেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, বিগত দিনে যারা বিদ্রোহীদের মদদ দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্থানীয় সরকারের বেশকিছু নির্বাচন সামনে হবে। এখন কঠোর ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে বিদ্রোহীদের মদদ দেয়া কমে যাবে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দলের প্রধান শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটা বাস্তবায়ন করার বিষয়েই সভাপতিমণ্ডলীর সভায় আলোচনা হয়েছে।দলীয় সূত্রমতে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া বিদ্রোহীদের মদদদাতা এক এমপি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় সংসদে দেখা করতে যান।
তখন সেই এমপির সঙ্গে দেখা না দিলেও পরে দেখা হয় প্রধানমন্ত্রীর। তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি সেই এমপির বিষয়ে তুলে ধরেন। কে কীভাবে নৌকাকে পরাজিত করার জন্য কাজ করেছেন তা বলেন। শুধু সংসদে নয়, গণভবনেও অনেক এমপির সঙ্গে দলীয়প্রধান দেখা করেননি বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তবে নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া একাধিক মন্ত্রীর ব্যাপারেও সভাপতি শেখ হাসিনা নাখোশ রয়েছেন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, বিদ্রোহীদের ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে। তাদের (বিদ্রোহী) সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা। সেই কাজটি আমরা সব জায়গায়ই করেছি।
কখন, কোন পরিস্থিতিতে কতটুকু অপরাধ করেছে তা আমরা পর্যবেক্ষণ করবো। তারপর আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। যেসব এমপি দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তাদের বিষয়ে দলের সভাপতি বলেছেন- সামনে মনোনয়ন দেয়া হবে না।
তিনি বলেন, দলের কার্যনির্বাহী বৈঠকে তার দায়িত্বপ্রাপ্ত খুলনা বিভাগের এমপিদের অবস্থান তুলে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলাম। সেখানে একজন এমপির অবস্থান তুলে ধরা হয়েছিলো। বৈঠকের বেশ কিছুদিন পর দলের সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে আসেন সেই এমপি।
প্রথমে দলের সভাপতি দেখা দেননি। পরে তাকে ডেকে বলেছিলেন ‘নৌকাকে নিয়ে কী কী খেলেছো সবই জানি। তারপরও কেন এসেছো?’ আওয়ামী লীগের সভাপতি অভিযুক্ত এমপিদের দেখা করার সুযোগ না দেয়াকেই চূড়ান্ত শাস্তির ধারাবাহিকতা বলে মনে করছেন এ সাংগঠনিক সম্পাদক।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ আরিফ খান
Developed by Shafayet IT