86 বার পঠিত
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও কারফিউ জারীকে কেন্দ্র করে ঝালকাঠির পেয়ারাচাষীদের কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পেয়ারা মৌসূমের শুরুতেই হোচট খেয়েছে চাষীরা। এমনিতেই এবছর ফলন কম হওয়ায় হতাশার পরিবর্তে ন্যায্য দামের আশায় বুক বেধেছিলো চাষীরা। কিন্তু দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে সে আশায় যেন গুড়ে বালি লেগেছে। পাইকার, ক্রেতা ও পর্যটক সংকটের কারণে পেয়ারার চাহিদা কম থাকায় কাঙ্খিত দাম না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। সেই সাথে পেয়ারা বাজারকে ঘিরে মৌসূমী ব্যবসায়ীরাও মন্দা অবস্থায় পড়েছেন। সব মিলিয়ে কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানান চাষীসহ সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, কম বেশি সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পেয়ারার চাষ হলেও বরিশালের বানারিপাড়া, ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। বরিশালের বানারিপাড়ার ১৬ গ্রামে ৯৩৭হেক্টর, ঝালকাঠি জেলার ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে, স্বরূপকাঠির ২৬ গ্রামের ৬৪৫হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খালজুড়ে পেয়ারার সমারোহ থাকে।
এদিকে ঝালকাঠির কীর্ত্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদশকাঠি, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়কাঠি, জগদীশপুর, মীরকাঠি, শাখা গাছির, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর এই গ্রাম গুলোর বৃহৎ অংশ জুড়ে বাণিজ্যিক ভাবে যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। তবে এবার গাছ গুলোতে দেরিতে ফুল এসেছে। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় সেই ফুল অনেকটাই ঝরে পড়েছে। দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়ায় পেয়ারাচাষী ও মৌসূমী ব্যবসায়ীদের এককোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। স্বাভাবিক না হলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
স্থানীয় চাষীরা জানান, আনুমানিক ২শ’ বছরেরও বেশি সময় আগে বিচ্ছিন্ন ভাবে আবাদ হলেও ১৯৪০ সাল থেকে শুরু হয়েছে পেয়ারার বাণিজ্যিক আবাদ। এ আবাদ ক্রমশ বাড়ছে। ২০২৪ সালেও অন্তত ১৯৩২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক পেয়ারার আবাদ হয়েছে।
কৃষক পঙ্কজ বড়াল বলেন, পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফুল এসেছিল এ বছর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তা অনেকটাই ঝরে পড়েছে। পদ্মা সেতু চালু হবার পরে পর্যটক ও পাইকারদের আনাগোনা বেড়েছে। কিন্তু মৌসূমের শুরুতেই দেশের অবস্থা ভালো না হওয়ায় পাইকার, ক্রেতা ও পর্যটক না আসায় পেয়ারার চাহিদা তূলনামূলক অনেক কম। ন্যায্য দাম তো দূরের কথা নামমাত্র মূল্যেও বিক্রি করতে পারছি না। লাভ তো দূরের কথা, আসল খরচের টাকাই ওঠে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
কৃষক দেবব্রত হালদার বিটু বলেন, পেয়ারা আমাদের মৌসুমি আয়ের একমাত্র অবলম্বন। পেয়ারার ফলন ভালো হলে আমাদের সচ্ছলতা আসে। পানির ওপরই ভাসমান হাটে বছরে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়। অস্থায়ী কিছু দোকান পাট বসে পাইকার, পর্যটক/দর্শনার্থীদের আপ্যায়নের বা ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যমে ব্যবসার করে আর্থিক ভাবে লাভবান হন বিক্রেতারা। কিন্তু দেশে সহিংস পরিবেশ বিরাজ করায় পাইকার আগমনসহ সবকিছুতেই এর একটা খারাপ প্রভাব পড়তেছে। বাজারের যে অবস্থা তাতে পেয়ারাও গাছ থেকে পারতে ইচ্ছাই করে না।
আরেক কৃষক বিপুল চক্রবর্তি বলেন, আমরা সংসারে তিনজন পুরুষ পেয়ারা বাগানের পরিচর্যাসহ সব ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকি। বছরের এ মৌসুমটায় আমাদের আয় দিয়ে সারা বছর সংসার চলে। এবছর ফলন কম হয়েছে, তার মধ্যে আবার কারফিউ। যদি ন্যায্য দাম না পাই তাহলে মৌসুমের তিনমাসই সংসার চালানো দুঃসাধ্য হবে। বাকি সময়টাতে কীভাবে চলবো তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
পর্যটন ব্যবসায়ী সুজন হালদার শানু বলেন, পেয়ারা মৌসুমকে ঘিরে দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক আসেন। আগে শুধুমাত্র নৌপথে আসতো, এখন সড়কপথ ভালো হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই যাতায়াত সম্ভব বলে পর্যটকদের সংখ্যা আগের থেকে বাড়ছে। পেয়ারাচাষিদের বাগানে ঢুকে ক্ষতিসাধন হওয়ায় আমরা পেয়ারা বাগানে নান্দনিক ভ্রমণের সুযোগ করেছি। কিন্তু এবছর যেভাবে পেয়ারার বাজারের শুরুতেই দেশের যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে তেমন পর্যটক বা দর্শনার্থীরা আসবেন বলে মনে হয় না। কারণ পর্যটক বা দর্শনার্থীরা নিরাপদে যাতায়াতকেই প্রধান্য দেন। এবছর সবদিক থেকেই লোকসানের মুখে পড়বে এখানকার লোকজন।
পেয়ারা চাষী ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ভবেন হালদার বলেন, শ্রাবণ মাসের শুরু থেকেই পাকা পেয়ারার মৌসূম শুরু হয়। আর তখন কোটা আন্দোলনের নামে দেশে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। পাইকার, ক্রেতা, পর্যটক তূলনামূলক আসছে না বললেই চলে। এমন পরিস্থিতিতে খরচ পোষানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ঝালকাঠি সদর উপজেলার ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ হয়। পেয়ারা মৌসুমে এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ফুল কিছুটা ঝড়ে গেছে। তবুও যা আছে তার ঠিকমতো ন্যায্য দাম পেলে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু কোটা সংস্কারের নামে দেশের বর্তমান অবস্থার কারণে পাইকার, ক্রেতা, পর্যটক না আসায় বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হবে।