চট্টগ্রামে গত তিন ধরে থেমে থেমে গুড়ি গুড়ি ও হালকা থেকে মাঝারি আকারের বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে পাহাড় ধসের ঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যার আওতায় রয়েছে ৩০ হাজার ৭৮৬ জন মানুষ। পাহাড় ধস হলে এর প্রায় ৬০ শতাংশই মাটির ভেতরে আটকা পড়বে। মারা যাবে ১০ শতাংশ মানুষ।
এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ সুমন সাহা বলেন, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে চট্টগ্রামে গত শুক্রবার ভোর থেকে থেমে থেমে গুড়ি গুড়ি এবং হালকা থেকে মাঝারি আকারের বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
আগামী তিনদিন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু দেশের অবশিষ্টাংশে বিস্তার লাভ করতে এবং বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে। এতে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায় পাহাড় ধসের ঝুঁকি তৈরী হয়েছে। এ বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।
চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি জহুরুল আলম জসিম জানান, সিটি করপোরেশনের ১১টি ওয়ার্ডে অন্তত ৩০টি এলাকা পাহাড় ধসের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব পাহাড়ে ৪৬২৫টি ভবন ও অবকাঠামো পাহাড় ধসের ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। ওয়ার্ডগুলোতে পাহাড় ধস হলে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটবে বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, অতীতে চট্টগ্রাম মহানগরের যেসব পাহাড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বার পাহাড় ধস হয়েছে এবং সর্বাধিক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেই ওয়ার্ডগুলোকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই হিসেবে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে, ১নং দক্ষিণ পাহাড়তলী, ২নং জালালাবাদ, ৩নং পাঁচলাইশ, ৭নং পশ্চিম ষোলশহর, ৮নং শুলকবহর, ৯নং উত্তর পাহাড়তলী, ১৩নং পাহাড়তলী, ১৪নং লালখান বাজার, ১৫নং বাগমনিরাম, ১৬নং চকবাজার এবং ২২নং এনায়েত বাজার ওয়ার্ড।
এসব ওয়ার্ডে লালখান বাজার মতিঝর্ণা, টাঙ্কির পাহাড়, বাটালি হিল, গোলপাহাড়, এ কে খান পাহাড়, রৌফাবাদ পাহাড়, ফিরোজশাহ, কুসুমবাগ, জালালাবাদ পাহাড়, মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়, আরেফিন নগরসহ ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) প্রণীত মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ফর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বা চট্টগ্রাম শহরের আপদকালীন কর্মপরিকল্পনায় এসব তথ্য উঠে আসে।
কর্মপরিকল্পনাটির তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরে প্রায় ৩০ হাজার ৭৮৬ জন মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৭৭১ জন শিশু আছে। নিয়মিত পাহাড় ধস হলে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ ধসে পড়া কাঠামোর ভিতরে আটকা পড়বে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ মারা যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের অন্যান্য জায়গায় পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত শহরের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের বেশিরভাগ ঢালে অবৈধ দখলদার থাকে। পুনর্বাসন সমস্যার সমাধান করা না গেলে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পাহাড় ধসের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বাড়বে। প্রাণহানি এড়াতে বৃক্ষরোপণ ও বনায়নে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে এই কর্মরিকল্পনায়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, গত দুই যুগে চট্টগ্রাম মহানগরে ২৫৯ জন মানুষ মারা গেছেন পাহাড় ধসে। এর মধ্যে সর্বশেষ গত ৮ এপ্রিল আকবর শাহ থানার বেলতলী ঘোনায় মারা যায় একজন। এছাড়া দুই যুগ আগে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ১৯৯৯ সালের ১৩ আগস্ট। ওইদিন সিআরবি পাহাড়ের একাংশের সীমানা প্রাচীরসহ পাহাড় ধসে মারা যায় ১০ জন।
অবশ্য গত দুই যুগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওইদিন চট্টগ্রামের পৃথক সাতটি স্থানে পাহাড় ধসসহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই ঘটনার পর তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে (রাজস্ব) আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসনকে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলো।
তবে ওইদিন রেলওয়ে পাহাড়তলী এলাকার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ১২ জনের মৃত্যুর জন্য গঠিত একটি কমিটি ১৪টি এবং নগর ও আশেপাশের এলাকায় ভূমিধসে প্রাণহানির জন্য গঠিত ৩৬টি সুপারিশ করে।
রোববার (১১ জুন) সেই ভয়াবহ পাহাড় ধসের ১৬ বছর পূর্ণ হলেও ওইসব সুপারিশের বেশিরভাগ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে প্রায় প্রতিবছর নগরে পাহাড় ধসে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা।
এদিকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাহাড় কাটার ফলে ভূমির ঢাল বৃদ্ধি পায়, গাছপালার আচ্ছাদন বিনষ্ট হয়, মাটির দৃঢ়তা হ্রাস পায়, বৃষ্টির পানি মাটির গভীরে প্রবেশ করে গঠন প্রণালী হালকা করে তোলে। ভারী অবকাঠামো পাহাড় ধসের ঝুঁকি বাড়ায়। এতে পাহাড় ধস হয়।
মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ফর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাহাড় ধসের জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাত, মাটির একসাথে লেগে থাকার শক্তির স্বল্পতা, পাহাড়ের ঢালে বৃক্ষরোপণের কমতি, অবৈজ্ঞানিক এবং অবৈধভাবে পাহাড় কাটা, নি¤œ নিষ্কাশন ক্ষমতাকে দায়ী করা হয়। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী দ্বারা অবৈধ পাহাড় দখল ও কাটা। পাহাড়ে জোরপূর্বক অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন এবং রিয়েল এস্টেট কো¤পানির দ্বারা অনিয়ন্ত্রিতভাবে পাহাড় কাটা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহ জালাল মিশুক বলেন, পাহাড়ের পাদদেশ হল প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, যেখানে মাটি দখলকারীরা পাহাড় কাটে। এগুলো পাহাড়ের খাড়া ঢালের সৃষ্টি করে। তাই পাহাড়ের খাড়া ঢালে মাটি পিছলে যাওয়ার জন্যই উক্ত এলাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বর্ষাকালে ঢালগুলো তাদের স্থিতিশীলতা হারায় এবং কর্দমাক্ত মাটি আলগা হয়ে যায়। এসময় বৃষ্টির জলের অতিরিক্ত ওজন ধরে রাখতে না পেরে ভূমিধস হয়।
ভূমিধস এড়াতে বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে পাহাড় সংরক্ষণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য তাদের সামর্থ্যের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার আশেপাশে ভবন নির্মাণের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের সঠিক সময়ে পুনর্বাসন করতে পারে এমন স্থান সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করার জন্য প্রতি বছর ঝুঁকি মানচিত্র ও সঠিক পূর্বাভাস প্রদানকারী মডেল তৈরি করতে হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ আরিফ খান
Developed by Shafayet IT