95 বার পঠিত
দেশের তৈরি পোশাকশ্রমিকদের জন্য সাড়ে ১২ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি চূড়ান্ত করেছে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। যা আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। মজুরি বোর্ডের বৈঠকের পর মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এ ঘোষণা দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। এর আগে শ্রম ভবনে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে গঠিত বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় এই মজুরি চূড়ান্ত করা হয়। তবে সরকারের এ ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন শ্রমিকরা। যৌক্তিক পরিমাণে মজুরি বৃদ্ধি না করার প্রতিবাদে আগামী শুক্রবার সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ এবং নিরপক্ষে প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্রুত নতুন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। যে মজুরি আছে তার ওপর মূল মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ৮ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে। ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টও বহাল আছে।
সবশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে পাঁচ বছরের জন্য পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি ঘোষণা করে সরকার। সে অনুযায়ী আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নতুন মজুরি ঘোষণা করার দাবি ছিল শ্রমিকদের। পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঠিক করতে গত এপ্রিলে নিম্নতম মজুর বোর্ড গঠন করে সরকার। গত ২২ অক্টোবর এই বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করেন। আর মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়।
ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে এমন কথা ছড়িয়ে পড়লে ২৩ অক্টোবর থেকে গাজীপুরে আন্দোলন শুরু করেন পোশাক শ্রমিকরা। পরে তা আশুলিয়া, সাভার ও ঢাকার মিরপুরে ছড়িয়ে পড়ে।
অনেক জায়গায় শ্রমিকরা ভাংচুর শুরু করলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাধে। সংঘাতে এবং এক কারখানায় আগুন দেয়ার ঘটনায় প্রাণ যায় অন্তত দু’জনের। পরিস্থিতি সামাল দিতে পর্যায়ক্রমে পাঁচ শতাধিক কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়।
বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকরা মঙ্গলবারও গাজীপুরে দুই বাসে আগুন দিয়ে বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন।
মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমজীবীদের ওই আন্দোলনের কথা তুলে ধরে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে মালিক ও শ্রমিক পক্ষকে নিয়ে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। মজুরির যদি কোনো তারতম্য হয়ে যায়, আমরা শেষ সম্বল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হই সবসময়। উনার মৌখিক নির্দেশে আজকে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ঘোষণা করছি। এখানে শ্রমজীবী মানুষ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ আছে। শিল্প বাঁচলে শ্রমিক বাঁচবে। শ্রমিকের সাথে শিল্পও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উভয় দিক লক্ষ্য রেখেই মজুরি ঘোষণা করা হচ্ছে।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, শ্রমিকদের রেশনের দাবি আছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একটি পরিবারের জন্য একটি ফ্যামিলি কার্ডের মধ্যেই নির্ধারিত থাকবে কতগুলো সদস্য কার্ডটি ব্যবহার করতে পারবে। পরবর্তীতে এই কার্ডের মাধ্যমে রেশনিং ব্যবস্থা চালুর কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। শ্রমিক নেতা ও মালিকরা যারা আছেন, আমি প্রত্যেকের কাছে আহ্বান জানাব, আপনারা ফ্যাক্টরি খুলে দেবেন, শ্রমিক ভাইদের বলব কাজে যোগদান করতে। উভয় পক্ষের কাছে আমি আবেদন করব মালিকদের সহনশীল ভূমিকা রাখার জন্য, তার কারণ এই আন্দোলনে ভুল করুক, ক্রটি করুক, যেটিই করুক, পেটের দায়েই তো মানুষ অনেক কিছু করে। তাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে কর্মে যেন তারা সঠিকভাবে যোগ দিতে পারে।
মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএর সভাপতি সেলিম ওসমান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
পোশাক শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণার বিষয়ে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি ও মজুরি বোর্ডে থাকা শ্রমিক প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, আমরা খুশির অবস্থায় নেই। রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন পরিস্থিতি মিলিয়ে আমরা এটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমরা খুশিও না, বেজারও না। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকলেও আমরা আপাতত এটা মেনে নিয়েছি। আমাদের অনেকগুলো দাবি আছে, গেজেট হওয়ার সময় সেগুলো পরিষ্কার হওয়া যাবে।
সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, আমি ৪০ বছর ধরে এই খাতে কাজ করছি। আমাদের বাস্তব অবস্থাকে বিবেচনায় নিতে হবে। শ্রমিকরা যাতে কর্মচ্যুত না হয়, তাদের যেন বাড়ি ফিরে যেতে না হয়, তাদের অবস্থা আমাদের দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা (মজুরি প্রসঙ্গে) দিয়েছেন… সে অনুসারে আমরা মনে করি, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বেঁচে থাকার জন্য এটা মোটামুটি একটা অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে। এটা গ্রহণযোগ্য।
এদিকে পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও মজুরি বোর্ডে থাকা মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মালিকপক্ষ সবসময় সহনশীল। মালিকপক্ষের সামনে দিয়ে যখন শ্রমিকরা ভাঙচুর করে, আমরা কিন্তু কখনো আমাদের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাই না।
তিনি বলেন, শ্রমিকরা কাজ করেনি, তারপরেও ফ্যাক্টরি বন্ধ রেখেছি, আমরা যথেষ্ট সহনশীল। ডিসেম্বরের বেতন
নতুন বেতনের আলোকে হবে। গেজেট এখনই করতে দেবে, কোনো সংশোধন থাকলে ১৪ দিনের মধ্যে করা হবে। এরপরে আরেকটি মিটিং হবে, সেই মিটিংয়ে সবকিছু ফাইনাল করা হবে।
গেজেট কবে প্রকাশ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনই গেজেট করতে দেয়া হবে। তাতে যদি কোনো সংশোধন থাকে, সেটি ১৪ দিনের মধ্যে করা হবে। ১৪ দিন পর আরেকটি বৈঠক হবে, সেখানে গেজেট চূড়ান্ত করা হবে।
এদিকে নুন্যতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছেন শ্রমিকদের একটি অংশ।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা প্রত্যাখান করছি। মজুরি বৃদ্ধির আমাদের যে দাবি সেটি সরকারকে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, মজুরি বৃদ্ধির দাবি আদায়ে ১১ সংগঠন নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন’ প্ল্যাটফর্ম। এ প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে আগামী শুক্রবার আমরা প্রতিবাদ সমাবেশ করব।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইল বলেন, সরকারের কাছে আমরা ২৫ হাজার টাকা মজুরি করার দাবি জানিয়েছি। সরকার সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ অর্ধেক করার ঘোষণা দিয়েছে। আমরা এই দাবি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছি।
ন্যূনতম বেতন ২৫ হাজার টাকা করার দাবিতে এবার আন্দোলন করছে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, গার্মেন্টস শ্রমিক ও শিল্পরক্ষা জাতীয় মঞ্চ, গার্মেন্টস ওয়াকার্স অ্যালায়েন্স, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন ও গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।