28 বার পঠিত
সম্প্রতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ- কে নিষিদ্ধকরণ, ছাত্র শিবির কিংবা ছাত্রদল-কে একঘরা করে রাখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে বাঙ্গালি জাতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণ নাকি সংস্কার?’, এ প্রশ্ল উঠে এসেছে বারবার। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের স্বপ্ন দেখেছে হাজারো শিক্ষার্থী।
ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির রয়েছে এক গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস। নিজেদের অধিকার আদায়ে ও নানাবিধ সুবিধা পাওয়ার জন্য একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সমিতি করে রাজনীতি শুরু করেন। যেমন নোয়াখালী-কুমিল্লা, হুগলি, বারাসাত, আসাম, বরিশাল, ঢাকা ইত্যাদি। ১৯৩২ সালে মুসলিম লীগের হাত ধরে প্রথম রাজনীতিতে আসে ছাত্ররা। কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নির্দেশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে মুসলিম লীগের অধীনে ছাত্রদের একটি সংগঠন ‘অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লিগ’ গঠন করেন। বাংলায় নাম ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। এরপর থেকেই লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদের অংশগ্রহণে ইতিহাসে রচিত হতে থাকে একেরপর এক আন্দোলন।
• ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন – সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতের রক্তের বিনিময়ে ছাত্ররা পায় এক গৌরবময় ইতিহাস। নিজেদের মাতৃভাষা রক্ষায় শহীদ হন ঢাবির এ মেধাবী শিক্ষার্থীবৃন্দ।
• ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন – প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সুপারিশকৃত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আবার একত্রিত হয় ছাত্রসমাজ। ঢাকা কলেজের নেতৃত্বে ‘কমিশন অন ন্যাশনাল এডুকেশন’ বাতিল করতে সেসময় মাঠে নামে সারাবাংলার সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
• ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন – বাঙ্গালী জাতির মুক্তির সনদ ‘৬ দফা আন্দোলন’ – এ ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা ছিলো অবিস্মরণীয়। জনমত গঠন করে ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি সংগৃহীত হয়েছিল।
• ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান – তৎকালীন ডাকসু’র ভিপি তোফায়েল আহমেদের তত্ত্বাবধানে গণ- অভ্যুত্থানের সাক্ষি হয় এই জাতি। ২০শে জানুয়ারি ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের মৃত্যুতে বেগ পায় এই আন্দোলন। আসাদের জামা দিয়ে পতাকা বানানোর শপথ নেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
• ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ দেয় ছাত্রনেতা নূর হোসেন। “স্বৈরাচার নিপাকে যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” স্লোগানটি নিজের বুকে ধারণ করে শহীদ হোন তিনি।
• কোটা সংস্কার আন্দোলন – ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি তুলেন ছাত্রনেতারা। নিজেদের অধিকার আদায়ে গড়ে তুলেন এক বৃহৎ আন্দোলন। যা পরবর্তীতে সফল হয়।
• নিরাপদ সড়ক আন্দোলন – ২০১৮ সালে রাজধানী ঢাকায় দুই শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর থেকে নিরাপদ সড়কে দাবিতে মাঠে নামে দেশের আপামরসাধারণ শিক্ষার্থী।
• বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন – কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাইদ পুলিশের গুলিতে নিহত হবার পর শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে জুলাই বিপ্লবের স্মৃতি এখনো তাঁজা।
যখনই দেশ ও জাতি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে ঠিক তখনি নিজেদের জীবন দিয়ে তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছেন ছাত্রনেতারা। গঠন করেছেন সঠিক ভাবাদর্শ। সম্প্রতি সময়ে কোনো ছাত্র সংগঠন-কে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। একদিকে মানুষ ভাবছে ছাত্ররাজনীতির সংস্কার প্রয়োজন, যাতে করে জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্ররা ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে আরেকদল ভাবছে, বিশ্ববিদ্যালয় হলো গবেষণার জায়গা। এখানে ছাত্র রাজনীতির চর্চা অযৌক্তিক।
ছাত্র রাজনীতি কেন প্রয়োজন?
দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে। একজন ছাত্র তার ছাত্রজীবনে যে শিক্ষা অর্জন করে তা সে সারাজীবন বহন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্ল্যাটফর্মে এসে রাজনীতি চর্চা করে যখন একজন ছাত্র নিজেকে একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে তখন সাধারণ জণগণ সহজেই তার উপর আস্থা রাখবে। তৈরি হবে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক কালচার। অপরদিকে ছাত্ররাজনীতি চর্চা করতে না পারলে দেশের রাজনীতির মান হবে খারাপ।
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির বিকল্প ছাত্র সংসদ নির্বাচন :
বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠন একটি নির্দিষ্ট দলকে রিপ্রেজেন্ট করে। তারা কখনোই ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করে না। দলীয় প্রধানের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে একজন ছাত্র সম্পূর্ণ ছাত্রসমাজের কথা বলতে পারে না। ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তি কেবলমাত্র হতে পারে ছাত্র সমাজের প্রতিনিধি। ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্র জীবনেই গণতন্ত্র চর্চার স্বাদ পাবে। নিজের চিন্তা শক্তি প্রতিফলিত করার সুযোগ পাবে। ছাত্রসংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধির কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি জড়িত হওয়ার সুযোগ কম। তাই ছাত্রদের বাইরে চিন্তা করার তার কোনো অবকাশ নেই।
ছাত্ররাজনীতির অবর্তমানে অপরাজনীতির চর্চা বৃদ্ধি পাবে :
ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা হলে দেশ মুখপাত্র হারাবে। পূর্বে আমরা দেখেছি দেশের প্রয়োজনে নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কিভাবে ছাত্র সমাজ দলমত নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে লড়াই করেছে। বারবার রক্ষা করেছে এইদেশ কে। ছাত্ররাজনীতির অবর্তমানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সে শক্তি আর থাকবে না সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। স্বার্থবাদী শক্তি’রা তখন খুব সহজেই তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারবে। যার বিরুদ্ধে দাড়ানোর কেউ থাকবে না।
ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস এক গৌরবময় ইতিহাস। দেশের সকল ঐতিহাসিক অর্জন ছাত্রদের এনে দেওয়া। বাংলার ছাত্র সমাজ নিজেদের মাতৃভাষা রক্ষায় জীবন দিয়ে ইতিহাসের পাতায় যে নাম লিখেছেন তা কখনোই মুছে যাবার নয়। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলে দেশের মেরুদন্ডে আঘাত আসবে। তাই ছাত্ররাজনীতির যৌক্তিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি।